মশা মানুষের জন্য একধরনের বিরক্তিকর এবং হানিকারক পোকা। তারা শুধু আমাদের রক্ত চুষে নেয় না, তারা ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া এবং আরও অনেক মারাত্মক রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ী। মশারা তাদের শিকার খুঁজতে গন্ধের উপর নির্ভর করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সংকেতকে অনুসরণ করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার আগে, মশার গন্ধ সংবেদন প্রক্রিয়া এবং CO₂ এর ভূমিকা সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা যাক।
মশার গন্ধ সংবেদন প্রক্রিয়া
মশারা তাদের শিকার খুঁজতে গন্ধের উপর নির্ভর করে। তাদের গন্ধ সংবেদন প্রক্রিয়া খুবই উন্নত এবং সূক্ষ্ম। মশাদের অ্যান্টেনা এবং ম্যাক্সিলারি পাল্প নামে পরিচিত বিশেষ অঙ্গ আছে যা গন্ধের কণা শনাক্ত করতে সক্ষম। এদের অ্যান্টেনা এবং ম্যাক্সিলারি পাল্পে অসংখ্য গন্ধ রিসেপ্টর থাকে, যা শিকার থেকে নির্গত গন্ধ শনাক্ত করে এবং মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়।
গন্ধ শনাক্ত করার জন্য মশারা প্রধানত তিনটি ধরনের সংকেত অনুসরণ করে:
১. কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂): মশারা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বের হওয়া CO₂ গ্যাসের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। যখন আমরা শ্বাস প্রশ্বাস করি, তখন CO₂ গ্যাস নির্গত হয়। এই গ্যাস মশাদের শিকার নির্ধারণের জন্য প্রধান সংকেত হিসাবে কাজ করে। মশারা প্রায় ৫০ মিটার দূর থেকে CO₂ গ্যাস শনাক্ত করতে পারে এবং এর উৎসের দিকে উড়ে যেতে পারে।
২. শরীরের গন্ধ: মানবদেহ থেকে নির্গত ঘাম এবং অন্যান্য রাসায়নিক যৌগ মশাদের আকৃষ্ট করে। আমাদের শরীর থেকে নির্গত ল্যাকটিক অ্যাসিড, অ্যামোনিয়া এবং অন্যান্য ভোলাটাইল যৌগ মশাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এসব যৌগ মশাদের কাছে শিকারের উপস্থিতির সংকেত হিসাবে কাজ করে।
৩. তাপমাত্রা: মশারা তাপ সংবেদন করতে পারে এবং উষ্ণ রক্তের প্রাণী যেমন মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের দিকে আকৃষ্ট হয়। শরীরের তাপমাত্রা মশাদের শিকার নির্ধারণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত।
কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) এর ভূমিকা
CO₂ মশার শিকার নির্ধারণের প্রাথমিক সংকেত হিসাবে কাজ করে। যখন আমরা নিঃশ্বাস ত্যাগ করি, তখন CO₂ গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। মশারা তাদের বিশেষ রিসেপ্টরের মাধ্যমে এই গ্যাস শনাক্ত করে এবং এর উৎসের দিকে উড়ে যায়।
বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে মশারা CO₂ এর প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এটি তাদের শিকার নির্ধারণের প্রধান উপাদান। মশারা CO₂ এর উৎসের দিক নির্দেশক হিসেবে বাতাসের প্রবাহ অনুসরণ করতে পারে। এটি তাদের শিকার নির্ধারণ এবং এর দিকে উড়ে যাওয়ার জন্য একটি কার্যকর উপায়।
শরীরের গন্ধের প্রভাব
শরীর থেকে নির্গত বিভিন্ন ভোলাটাইল যৌগ মশাদের আকৃষ্ট করে। আমাদের ত্বক থেকে নির্গত ঘাম এবং অন্যান্য রাসায়নিক যৌগ মশাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। আমাদের ত্বকের মাইক্রোবায়োমও মশাদের আকৃষ্ট করতে ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ত্বকের পৃষ্ঠে বাস করে এবং এরা নির্দিষ্ট ধরনের গন্ধ উৎপন্ন করে যা মশাদের আকৃষ্ট করতে পারে।
শরীরের গন্ধের প্রভাব সম্পর্কে আরও ভালো বোঝার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক যৌগ নিয়ে আলোচনা করা যাক:
১. ল্যাকটিক অ্যাসিড: ঘামের মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে ল্যাকটিক অ্যাসিড নির্গত হয়। মশারা এই অ্যাসিডের গন্ধ শনাক্ত করতে পারে এবং এটি তাদের শিকার নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংকেত।
২. অ্যামোনিয়া এবং অন্যান্য অ্যামাইন যৌগ: আমাদের ঘামের সাথে কিছু পরিমাণ অ্যামোনিয়া এবং অন্যান্য অ্যামাইন যৌগ নির্গত হয়। মশারা এসব যৌগের প্রতি সংবেদনশীল এবং এরা মশাদের কাছে আকর্ষণীয়।
৩. অক্টেনল: এটি একটি প্রাকৃতিক ভোলাটাইল যৌগ যা আমাদের নিঃশ্বাস এবং ঘামের সাথে নির্গত হয়। অক্টেনল মশাদের জন্য আকর্ষণীয় এবং এটি তাদের শিকার নির্ধারণে সহায়ক।
তাপমাত্রার ভূমিকা
মশারা তাপ সংবেদন করতে সক্ষম। উষ্ণ রক্তের প্রাণী যেমন মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের শরীরের তাপমাত্রা মশাদের আকৃষ্ট করে। তাপ সংবেদনশীল রিসেপ্টরদের মাধ্যমে মশারা তাপের উৎস শনাক্ত করতে পারে এবং এর দিকে উড়ে যায়।
মানুষের শরীরের তাপমাত্রা মশাদের কাছে আকর্ষণীয় কারণ এটি শিকারের উপস্থিতি নির্দেশ করে। মশারা তাপের উৎসের দিকে উড়ে যায় এবং তাপমাত্রার পার্থক্য শনাক্ত করে শিকার নির্ধারণ করে।
মশারা গন্ধ, CO₂, শরীরের গন্ধ এবং তাপমাত্রার মাধ্যমে তাদের শিকার খুঁজে বের করে। মশার শিকার নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় CO₂ এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, শরীরের গন্ধ এবং তাপমাত্রা মশাদের শিকার নির্ধারণে সহায়ক হয়। মশার এই প্রাকৃতিক শিকার অনুসন্ধান পদ্ধতি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কেন তারা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয় এবং কীভাবে আমরা তাদের থেকে রক্ষা পেতে পারি।
মশা কত দিন বেঁচে থাকে?
মশার আয়ুষ্কাল অনেকটা প্রজাতি, পরিবেশ এবং তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। একটি পূর্ণ বয়স্ক এডিস মশা গড়ে ১৫-৪০ দিন বাঁচে। এডিস মশার আয়ু মূলত তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। শীতকালে এডিস মশা সাধারণত বেশি দিন বাঁচে, আবার গরমকালে এডিস মশার বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার দ্রুত হয় বলে এই সময়ে এডিস মশা কম দিন বাঁচে। এছাড়া, বিভিন্ন প্রজাতির মশার আয়ুষ্কালেরও তারতম্য থাকে।
একটা মশা কত ডিম পাড়ে?
স্ত্রী মশাকে আকৃষ্ট করতে খুব অল্প পরিমাণ পানি লাগে। মশা সাধারণত একবারে ১০০টি ডিম পাড়ে।
মশার প্রধান খাদ্য কি?
মশার প্রধান খাদ্য আসলে ফুলের রস এবং ফলের রস। পুরুষ মশারা শুধুমাত্র ফুলের রস এবং ফলের রস খেয়ে বেঁচে থাকে। তবে, স্ত্রী মশারা রক্ত খেয়ে থাকে, যা তাদের ডিম উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।
মশার খাদ্যাভ্যাস:
১. পুরুষ মশা:
o প্রধানত ফুলের রস এবং ফলের রস খায়।
o তাদের শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করতে এই মিষ্টি রস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. স্ত্রী মশা:
o ফুলের রস এবং ফলের রস খেয়ে বেঁচে থাকে।
o ডিম উৎপাদনের জন্য রক্ত খায়। মানুষ, পোষা প্রাণী এবং অন্যান্য উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের রক্ত স্ত্রী মশাদের প্রধান খাদ্য উৎস হিসেবে কাজ করে।
o রক্ত থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন এবং লিপিড তাদের ডিম উৎপাদনে সহায়তা করে।
রক্ত খাওয়ার কারণ:
স্ত্রী মশারা ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রক্ত থেকে সংগ্রহ করে। রক্তে উপস্থিত হেমোগ্লোবিন, প্রোটিন, এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান মশাদের ডিম উৎপাদনে সহায়ক হয়। মশার লালা রক্তের জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে, যা মশাদের রক্ত চুষতে সহায়তা করে। মশারা রক্ত খাওয়ার সময় তাদের লালা আমাদের ত্বকে প্রবেশ করায়, যা চুলকানি এবং ফোলাভাব সৃষ্টি করে।
মশার এই খাদ্যাভ্যাস এবং রক্ত চোষার প্রক্রিয়া তাদের রোগবাহিত করে তোলে, যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, জিকা ভাইরাস ইত্যাদি। তাই মশা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মশার প্রিয় রক্ত কি?
তবে, এক্ষেত্রে আপনার রক্তের গ্রুপ দায়ী হতে পারে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপের ওপর মশার নজর থাকে। আর সেটি হলো 'ও' গ্রুপের রক্ত। মশারা অন্যান্য রক্তের গ্রুপের তুলনায় এটি বেশি পছন্দ করে।
মশা কোন রক্ত সবচেয়ে কম পছন্দ করে?
রক্তের ধরন মশা সবচেয়ে পছন্দ করে
টাইপ বি: টাইপ বি জনপ্রিয়তায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। টাইপ A : টাইপ A ব্লাড টাইপ দৃশ্যত মশার কাছে সবচেয়ে খারাপ স্বাদের। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে যাদের রক্তের ধরন A আছে তাদের টাইপ ও-এর তুলনায় মশার কামড়ের সম্ভাবনা 50% কম।
মশার কামড়ের সবচেয়ে ভালো ঔষধ কোনটি?
এটি ক্যালামাইন লোশন বা একটি নন-প্রেসক্রিপশন এন্টিহিস্টামিন ক্রিম বা কর্টিকোস্টেরয়েড ক্রিম প্রয়োগ করতে সাহায্য করতে পারে। অথবা বেকিং সোডা এবং জল দিয়ে তৈরি একটি পেস্ট দিয়ে কামড়টি ড্যাব করার চেষ্টা করুন। ক্রিম বা পেস্ট দিনে তিনবার লাগান যতক্ষণ না চুলকানি চলে যায়।
মেয়েদের মশা বেশি কামড়ায় কেন?
তার কারণ ইস্ট্রোজেন হরমোনের ক্ষরণ। নারীদের শরীরে এ বিশেষ হরমোনের মাত্রা বেশি বলে, তাদের গায়ে বিশেষ গন্ধ থাকে, যা নাকি মশাদের পছন্দ।